বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার শুকতাইল গ্রামে ১৯৩৫ সালের ৮ মার্চ অধ্যক্ষ মাওলানা মুনীরুযযামান ফরিদী'র জন্ম। পিতা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ও পল্লী চিকিৎসক মোহাম্মদ ঈমান উদ্দীন বিশ্বাস এবং মা নূরজাহান বেগমের ৭ সন্তানের প্রথম সন্তান তিনি। পিতার কাছেই পড়াশোনার হাতেখড়ি।
উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ রাজত্বের অস্তপ্রহর। মুনীরুযযামানের তখনো প্রাথমিকের পাঠ চুকেনি। স্বাধীনতার পাদপ্রান্তে উপমহাদেশে সেসময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুই ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে জানতে গিয়ে রাজনৈতিক সচেতনতার শুরু হয় তার।
দেখা হয় এলাকার তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুজিব ভাই’র সাথে।
১৯৫০ সালে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খা’র লেখা ‘ইছলামের মর্মকথা’ প্রবন্ধটি তার জীবনের চিন্তা-চেতনাকে বদলে দেয়। উপলব্ধি করেন, ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়। একটি সভ্যতা, একটি সংস্কৃতি। মানবগোষ্ঠীর ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ ও মঙ্গলের একমাত্র চাবিকাঠি।
পরের বছর ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানা ও বোঝার জন্য, মা-বাবার বাধা সত্তে¡ও, ভর্তি হন গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গার দারুল উলুম খাদিমুল ইসলাম মাদ্রাসায়। এখানে তিনি মাদ্রাসার প্রাথমিক ক্লাস অর্থাত ‘ইয়াজদহম’ থেকেই পড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকার লালবাগের জামি‘আ র্কুআ’নিয়া মাদ্রাসা থেকে ‘দাওরায়ে হাদীস’ পাস করেন।
৮ বছরের মধ্যেই তিনি কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন।
মাদ্রাসা থেকে মাওলানা হয়ে প্রায় ১০ বছর পর তিনি আবার আইএ-তে ভর্তি হন সেসময়ের গোপালগঞ্জ কায়েদে আযম মেমোরিয়াল কলেজে, যা বর্তমানে সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নামে খ্যাত। তিনি এই কলেজের ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিই এই কলেজে মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন।
এসময়ে তিনি গোপালগঞ্জ সন্নিহিত মোল্লাহাটের বড়গুনী গ্রামের প্রখ্যাত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন উদ্দীন আহমদের কন্যা ফাতিমা বেগমকে বিয়ে করেন।
বিএ পাশ করার পর গ্রামে ফিরে গিয়ে কিছুদিনের জন্য শুকতাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। মূলত ঐ সময়ে শুকতাইল গ্রামে আর কোনো বিএ পাশ করা লোক ছিলো না। তাঁর সময়ই স্কুলটি সরকারী মঞ্জুরী লাভ করে। তিনিই গ্রামের মাদ্রাসার নাম দেন ‘মুকীমুল ইসলাম’।
জনাব ফরিদী ১৯৬৫ সালে এমএ পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ‘জাহানে নও’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে চাকরী করেন।
১৯৬৭ সালে তিনি ইসলামিক স্টাডিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে পাশ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন।
১৯৬৮ সালে তার কর্মজীবন শুরু হয় মাদারীপুরের বরহামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে। তবে সত্তরের নির্বাচনে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে এলাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য চাকরী ছেড়ে দিয়ে ফিরে যান গোপালগঞ্জে।
১৯৭০ সালেই যোগদান করেন বরিশালে শেরে বাংলার জন্মভূমি চাখার গ্রামে শেরে বাংলা প্রতিষ্ঠিত সরকারী ফজলুল হক কলেজে। চাখারে জনাব ফরিদী নানারকম সামাজিক কর্মে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় পড়ে থাকা চাখার জামে মসজিদের সংস্কার, স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের জন্য চাখার ক্লাব একটি একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশের সেরা ইসলামী স্কলারদের নিয়ে চাখার হাইস্কুল মাঠে ৩দিন ব্যাপী তাবলীগী সেমিনারের আয়োজন করেন। সমগ্র বরিশাল অঞ্চলে সেসময়ে ইসলামী আলোচক হিসেবে বিভিন্ন সভা-মাহফিলে অংশ নিতেন তিনি।
১৯৮০ সালে তাকে সরকারী রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ফরিদপুরে বদলী করা হয়। কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি ফরিদপুরেও তার সামাজিক কর্মকান্ড অব্যহত ছিলো। ১২ বছর কলেজ মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফরিদপুরের ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভা-সেমিনার-সিম্ফোজিয়ামে প্রবন্ধ উপস্থাপনা বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন নিয়মিত। ফরিদপুর মুসলিম মিশন প্রতিষ্ঠাকালীন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আরামবাগ ইয়াতিমখানা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় অবদান রেখেছেন। দীর্ঘদিন টেপাখোলা জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি এবং পুরনো টিন-কাঠের অবকাঠামোকে বদলে ইমারত নির্মাণ করাসহ সংস্কার ও আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেন।
১৯৯২ সালে গোপালগঞ্জে সাতপাড় সরকারী নজরুল কলেজের সহ-অধ্যক্ষ এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করে তাকে বদলী করা হয়। এই কলেজে মাত্র এক বছরের চাকরী জীবনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এসেছেন।
১৯৯৩ সালে মুনীরুযযামান ফরিদী অবসর গ্রহণ করেন। তবে ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে অবসর নেননি। অবসর জীবনে ফরিদপুরে স্থায়ী বসতি নিয়েছেন শহরের টেপাখোলায়। বাসার পাশেই গড়ে তুলেছেন মসজিদ 'বায়তুল মাওলা'। বিগত দুই দশক ধরে তিনিই এই মসজিদের খাদেম, তিনিই খতীব-ইমাম আবার তিনিই সভাপতি।
৮৫ বছরের জীবনে তিনি পড়াশোনাকে ছাড়েননি। এখনো রাত জেগে পড়াশোনা করেনব্জ লেখালেখি করেন। তাঁর লেখা বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩টি।
Негізгі бет অধ্যক্ষ মাওলানা মুনীরুযযামান ফরিদীকে নিয়ে তথ্যচিত্র • Documentary on Principal Muniruzzaman Faridi
Пікірлер: 14