আদি বাদ্যযন্ত্রের দোকান যতীন এন্ড কোং।
যাঁরা সংগীত চর্চা করেন তাঁদের কাছে ‘যতীন অ্যান্ড কোং’ একটি পরিচিত নাম। পুরনো ঢাকার কোর্ট-কাচারি পেরিয়ে শাঁখারি বাজারের রাস্তা দিয়ে যেতেই ১৪ নম্বর শাঁখারি বাজারে যে দোকানটি; তাই বর্তমান ‘যতীন অ্যান্ড কোং’-এর ঠিকানা। দোকানের সামনেই পুরনো সাইনবোর্ডে লেখা ‘স্থাপিত ১৯১০ ইং’। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কেরানীগঞ্জের বাঘৈরে জন্ম নেওয়া যতীন্দ্র মোহন মণ্ডল।
১৯৭০ সালে যতীন্দ্র মোহনের মৃত্যুর পর তা এখন পরিচালনা করছেন তাঁর ছেলে সুনীল কুমার মণ্ডল ও নাতি সরজিৎ মণ্ডল।
যতীন্দ্র মোহনের জন্ম ১৮৮০ সালে। প্রাইমারি স্কুল শেষ না করতেই বসতবাড়ি চলে যায় বুড়িগঙ্গায়। অভিভাবকহীন কিশোর জীবিকার সন্ধানে ঢুকে পড়েন এক যাত্রাদলে।
যাত্রাদলের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হন, তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে হারমোনিয়াম। উনিশ শতকের শুরুতেই ঢাকা বিখ্যাত ছিল বাদ্যযন্ত্রের জন্য। সে সময় পাটুয়াটুলী, শাঁখারি বাজার, ইসলামপুর, তাঁতিবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের দোকান। ঢাকার আমপট্টিতে ছিল হারমোনিয়ামের দোকান ‘দাস অ্যান্ড কোং’।
যতীন্দ্র মোহন ঢাকায় এলেন হারমোনিয়াম সম্পর্কে জানতে। চাকরি করতে চাইলেন সে দোকানে। মালিক রাজি হলেন না। যতীন্দ্র মোহন বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুদিন দোকানে হারমোনিয়াম নির্মাণ দেখলেন। এরপর পিসির কাছ থেকে ১২ টাকা ধার নিয়ে নিজেই একটি হারমোনিয়াম তৈরি করলেন।সেটি বিক্রি করলেন ২৫ টাকায়। তারপর সে মুনাফা দিয়ে ১৯১০ সালে আশেক লেনে দোকান খুললেন, নাম দিলেন ‘যতীন অ্যান্ড কোং’। এভাবে তিনি বেশ কিছু হারমোনিয়াম তৈরি করে বিক্রি করলেন। তারপর সে মুনাফা দিয়ে ১৯২০ সালে দোকানটি ইসলামপুরে, এরপর পাটুয়াটুলীতে স্থানান্তর করেন। পাটুয়াটুলীতে দীর্ঘ ৭০-৮০ বছর ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দোকানটি পুরো ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। হারিয়ে যায় দুর্লভ সব বাদ্যযন্ত্র। পরে তাঁর ছেলে সুনীল কুমার মণ্ডল দোকানটি ১৪ নম্বর শাঁখারি বাজারে নতুনভাবে করেন।
দোকানটিতে এখন ৩৫-৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। শাঁখারি বাজার ছাড়াও পুরানা পল্টনে খোলা হয়েছে আরেকটি শাখা।
হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়। এর মধ্যে আছে হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, দোতারা, একতারা, ঢোলক, নাল, মেণ্ডলীন, সারিন্দা, ভায়লীন, খোল, এসরাজ, তানপুরা, সেতার, বেহালা বাঁশি, মৃদঙ্গ, ঢুমকো, ঢোল, জিপসী, খোল, মন্দিরা, কঙ্গো সবই এখানে পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিক্রি হয় হারমোনিয়াম ও তবলা।
এখানে ব্যবস্থাপক হিসেবে আছেন নবকুমার সাহা; কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘ব্রিটিশ আমলে গ্রামোফোন নামে কলের গান আবিষ্কার হলে ‘হিজ মাস্টার ভয়েজে’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতীন অ্যান্ড কোং ‘যতীন ফোন’ নামে কলের গান বাজারে ছেড়েছিল।’ তিনি আরো জানান, ‘বর্তমানে এ দোকানে তৈরি হারমোনিয়াম মান অনুযায়ী সাত হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। তবে ৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকার হারমোনিয়ামের চাহিদাই বেশি। সবচেয়ে বেশি দামি হলো বক্স হারমোনিয়ামের, দাম প্রায় ২৩ হাজার টাকা।’ এখন ব্যবসা কেমন জানতে চাইলে নবকুমার মণ্ডল বলেন, ‘জুন-জুলাই মাসে হারমোনিয়ামের বিক্রি ভালো হয়। এর কারণ সংগীত বিদ্যালয়গুলোতে এ সময় ভর্তি শুরু হয়।’
এখানে যেসব বাদ্যযন্ত্র বিক্রির জন্য রয়েছে, তাদের প্রায় সব নিজস্ব কারিগর দিয়ে তৈরি। এখানে যাঁরা ক্রেতা হিসেবে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই মফস্বল থেকে আসেন। আবার অনেক সময় বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে টেন্ডার দিয়েও কাজ করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে নবকুমার সাহা বলেন, ‘আমাদের এখানে ইতালি, ভারত, জার্মানি, ফ্রান্স-এসব দেশের বাঙালিরাও হারমোনিয়াম কিনে থাকেন। আগে পাকিস্তান থেকে কাওয়ালি গানের লোকেরা কিনত, এখন আর কেনে না। এখানে যেসব যন্ত্র আছে সবই আমাদের নিজস্ব। তবে গিটার আমরা ভারত থেকে নিয়ে আসি। কেউ বিদেশি যন্ত্র অর্ডার করলে তাঁকে এনে দিই।’
দোকানটির পেছনেই তাঁদের হারমোনিয়াম তৈরির কারখানা। সেখানে কাজ করছিলেন ছয়জন কারিগর। প্রত্যেকেই হারমোনিয়াম বানান এবং তাঁরা সবাই প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করেন। একটি হারমোনিয়াম বানাতে কেমন সময় লাগে-জানতে চাইলে কারিগর লক্ষ্মণ সরকার বললেন, ‘একটি হারমোনিয়াম বানাতে প্রায় আট দিনের মতো সময় লাগে। এক মাসে সর্বোচ্চ চারটি হারমোনিয়াম বানানো যায়। একটি হারমোনিয়ামে সাড়ে তিন হাজার টাকা মজুরি পাই, তা দিয়ে চারজনের সংসার চালাতে কষ্ট হয়।’
ব্যবসা নিয়ে সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে সুনীল কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমরা তিন পুরুষ ধরে এই ব্যবসা করে আসছি। তবে এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় নানা অস্থিরতার কারণে দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আগের চেয়ে কমে গেছে।সেই সঙ্গে শুদ্ধ সংগীত চর্চা করা লোকের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। সে কারণে বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গান শেখার প্রবণতাও অনেক কমে গেছে। কণ্ঠের কথা বলি আর একক বাদ্যযন্ত্র চর্চার কথাই বলি বাদ্যযন্ত্র ছাড়া সংগীতচর্চা অসম্ভব। তবে এখন কালের বিবর্তনে এবং ডিজিটাল সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যেন হারিয়ে না যায় অতীতের অনেক বাদ্যযন্ত্র এটাই আমার চাওয়া।’
একসময় ছিল যখন যতীন বাবুর দোকানে নিয়মিত শনি ও মঙ্গলবার গানের জলসার আয়োজন হতো। এ গানের জলসায় ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ, কাজী মোতাহের হোসেন, প্রসন্ন বণিক, ভগবান চন্দ, সেতারী থেকে শুরু করে সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এ জলসায় যোগ দিতেন। সমঝদার সংগীতজ্ঞ হিসেবে যতীন বাবু ঢাকার নবাববাড়ি, রূপলাল হাউস, গৌরীপুর, মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি, ত্রিপুরার রাজদরবারে সংগীত পরিবেশন করতেন। সংগীত জগতের এ নক্ষত্রের স্মৃতিবিজড়িত ‘যতীন অ্যান্ড কোং’ শাঁখারি বাজারে তাঁর স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে@ToTheFocus
------------------------------------------------------
#যতীনএন্ডকোং
#Jotin&co
#Historyofjatin&co.
#Jatin&co.
#আদিবাদ্যযন্ত্রেরদোকান
#পুরানঢাকারবিখ্যাতবাদ্যযন্ত্রেরদোকান
#হারমোনিয়ামেরদোকান
#যতীনেরবিখ্যাতহারমোনিয়াম
#শতবছরেরপুরানোযতীনএন্ডকোং
Негізгі бет Jotin & co.oldest musical instrument shop in dhaka city.আদি বাদ্যযন্ত্রের দোকান যতীন এন্ড কোং।
Пікірлер: 33