বাংলা পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের তখন রমরমা অবস্থা। প্রতাপ জহুরী নামে এক ব্যবসায়ীর আর্থিক সহযোগিতায় নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রসরাজ অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, বেনীমাধব মিত্তির এর মতো গুনী নাট্য ব্যক্তিত্বরা দাপিয়ে অভিনয় করছেন ন্যাশনাল থিয়েটারে। এখন আর ছেলেদের মেয়ে সেজে অভিনয় করতে হচ্ছে না, মেয়েরাই মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করছে। তবে সাধারণ বাড়ির মেয়েদের তখনও রঙ্গমঞ্চে পা দেওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। থিয়েটারে মেয়ে আসত নিষিদ্ধ পল্লী থেকে। শুধুমাত্র বারাঙ্গনারাই মঞ্চে অভিনয় করতেন। কোলকাতার এমনই এক বারাঙ্গনা বিনোদিনী আশ্রয় পায় নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের ছত্রছায়ায়। শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। বিনোদিনীর অভিনয়, গান, আবেগ ও প্রানবন্ততায় মুগ্ধ হয়ে যায় আপামর বাঙালার নাট্যরসিকরা। হাজার হাজার মানুষ টিকিট কেটে রোজ ভিড় করতে থাকে বিনোদিনীর অভিনয় দেখার জন্য। বিনোদিনী তখন বাংলার রঙ্গমঞ্চের মধ্য গগনের সূর্য।
অন্যদিকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর ভিষণ ইচ্ছে গিরিশ ঘোষের সাথে দেখা করার, তার নাটক দেখার। লোকমুখে গিরিশের নাটকের ভুয়সী প্রশংসা শুনে ঠাকুরের মন তখন ছটফছ করছে গিরিশকে একবার দেখার। কয়েকবার লোক পাঠিয়ে গিরিশকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। গিরিশ বারবার ঠাকুরের আমন্ত্রণ প্রত্যাক্ষান করেছেন ভিষণ অনিহায়। আসলে গিরিশ মনে মনে চেয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজে এসে তাঁর চরণধূলিতে পুন্য করুক বাংলার রঙ্গভূমিকে আর আশির্বাদ করুক এই অবহেলিত নট-নটীদের আর নিজের গুনে কাছে টেনে নিক গিরিশকে। অবশেষে একদিন তাই হলো। ঠাকুর নিজে এসে, ষোলো আনা দিয়ে টিকিট কেটে নাটক দেখলেন, আশির্বাদ করলেন সমস্ত নট-নটীদের। অভিভূত হলেন গিরিশের লেখনীতে, মুগ্ধ হলেন নিমাই চরিত্রে বিনোদিনীর অসাধারণ অভিনয়ে। এই শুরু হলো গিরিশ - ঠাকুর - আর বিনোদনীর ত্রিকোন নাটকীয় টানাপোড়েন।
অন্যদিকে প্রতাপ জহুরী আর থিয়েটার চালাতে পারছিলেন না। বিভিন্ন কারণে দলের সাথে তার সমস্যাও তৈরি হচ্ছিল। তাই অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাঞ্জাবের এক ধনকুবের গুর্মুখ রায়ের স্মরনাপন্ন হতে হয় ন্যাশনাল থিয়েটারকে। কিন্তু গুর্মুখের শর্ত একটাই। সে চায় বিনোদিনীকে। বিনোদিনীর অভিনয়, রূপে গুর্মুখ মুগ্ধ। বিনোদিনীকে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন। সাথে বাড়ি, গাড়ি, মাসোহারা সমস্ত সুখ-বৈভব, কিন্তু বিনোদিনী সব প্রত্যাক্ষান করে চলেছে থিয়েটারকে আঁকড়ে , নতুন জীবনকে ভালবেসে। অবশেষে গিরিশ ঘোষের মধ্যস্থতায় ও অনুরোধে বিনোদিনী রাজি হয় গুর্মুখের অঙ্গশায়িনী হতে শুধুমাত্র থিয়েটার যাতে বাঁচে সেই উদ্দেশ্যে। একদিকে অতীতের চোরা গলিতে ফেলে আসা রাঙাবাবুর বারবার ফিরে আসা-ভালবাসা- বিয়ের প্রস্তাব, অন্যদিকে গুর্মুখ চাইছেন নতুন থিয়েটারের নামকরণ হোক বিনোদিনীর নামে আর দলের কয়েকজন তখনও বিনোদিনীকে অপমানিত করে চলেছে বারাঙ্গনার তকমায়। দলের কয়েকজন স্পষ্টতই জানিয়ে দেন যে বিনোদিনীর নামে থিয়েটার হলে তারা আর থিয়েটারে থাকবেন না। এইরকম একটা ডামাডোল পরিস্থিতিতে জন্ম নিল - স্টার থিয়েটার।
সবকিছুই ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎই একদিন নাটকীয় সংঘাত নেমে এল। মদ্যপ অবস্থায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে অত্যন্ত অপমানিত করেন গিরিশ ঘোষ। গিরিশের দাবী ছিল ঠাকুর যেন তার ছেলে হয়ে জন্মায়। কিন্তু নেশাচ্ছন্ন চোখ আচ্ছন্ন করেছিল গিরিশের বোধকে। ঠাকুরকে ভুল বুঝে অকথ্য ভাষায় ভৎসনা করেন। এমনকি বিনোদিনীকেও অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন তিনি। পরে বিবেকের দংশনে যখন আত্মহত্যায় উদ্যোত গিরিশ তখন সেই দৈব মুহূর্তে ঠাকুর নিজে গিরিশের বাড়িতে এসে বুকে টেনে নেন তাঁর এই 'অবোধ শিশুটিকে' সাথে বকল্মাও নেন গিরিশের। এরপর থেকে ক্রমশই রোগাক্রান্ত হতে থাকেন ঠাকুর। মারণ রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে একদিন দেহ রাখেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
এদিকে শুধুমাত্র বিনোদিনীর অনুরোধে মাত্র ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে গুর্মুখ বিক্রি করেন স্টার থিয়েটার। দাশু নিয়োগী, অমৃত বোস এনারাই হন তখন স্টার থিয়েটারের মালিক। আর সবাইকে সবকিছু পাইয়ে দিয়ে নীরবে -নিভৃতে একবুক কষ্ট, লাঞ্ছনা নিয়ে খালি হাতে থিয়েটার ছাড়ে নটী বিনোদিনী। আশ্রয় দেন রাঙাবাবু। যবনিকা নেমে আসে।
#bengalitheatre #theatre #drama #play
Негізгі бет Фильм және анимация নটী বিনোদিনী-প্রযত্নে প্রয়াস- অষ্টম-ব্রজেন্দ্র কুমার দে-রণধীর রায়
Пікірлер: 9