পূর্বস্থলী। যে নামটা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে সবুজে ঘেরা বিশাল হ্রদ। আশে-পাশে ছোট, বড় আরও অসংখ্য জলাশয়। জলে মাছ, আর মাছ শিকারি কত রকমের পাখি। পাখিকে ভালবেসে তাই মানুষের আনাগোনাও এখানে লেগেই রয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার এই পূর্বস্থলীর আজ ‘চুপির চর’ নামেও সমান জনপ্রিয়। এই নামকরণের পিছনে কারণ যাই থাক, এখানে ঘুরতে এলে কিছুটা চুপচাপ তো থাকতেই হয়। bird waching-এর সেটাই যে শর্ত।
মাছ শিকারি পাখি বলতে যে নামগুলো সবার আগে মনে পড়ে, এখানে এলে তাদের দেখা পাওয়া প্রায় নিশ্চিত। মাছরাঙার মাছধরা নিয়ে শিশু সাহিত্যে কত ছড়াই না লেখা হয়েছে। কিন্তু তার রকমফের? হ্যাঁঁ, কমন, হোয়াইট ব্রেস্টেড, পায়েড, কলারড, স্টর্ক বিলড, প্রায় সব রকমের কিং ফিশারের দেখা মেলে। সেই সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসাবে মুখে মাছ বা কাঁকড়া থাকলে ছবির গুনগত মান অনেকটাই বেড়ে যায়।
পূর্বস্থলীর সিগনেচার সাইটিং? দু’পায়ের ধারালো নখে বড় একটা মাছ গেঁথে দু’টো ডানা মেলেছে মাছমুরাল। ইংরেজি ‘অস্প্রে’ নামেই অবশ্য সে বেশি পরিচিত।
শুধুই কি মাছ? উঁ হুঁ। ধানি জমি, জল, জলের ধারে ঝোপ, যেমন বহু পাখির পছন্দের আস্তানা, তেমনই এই জলা-জঙ্গলের সাপ, পোকা-মাকড় এদের ফেভারিট ডিশ। খাবার আর বাসস্থানের যখন সুবন্দোবস্ত রয়েছে, তখন পাখির মেলা তো বসবেই।
এখানকার পাখিদের সহজেই দুটো দলে ভাগ করা যায়। একদল এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। বছরের যে কোনও সময় এলেই এদের দেখা মেলে। এই দলে যেমন নানা রকম মাছরাঙা, বক, সারস, পানকৌড়ি , জাকানা রয়েছে তেমনই আছে সোয়ামফেন, রিভার ল্যাপউইং, গ্রেটার কাওকল, লেসার হুইসলিং ডাক, আরও কত পাখি।
আবার অন্য দলে রয়েছে পরিযায়ী পাখি। বছরের নির্দিষ্ট সময় দূর দেশ থেকে লম্বা উড়ান দিয়ে এখানে ল্যান্ড করে তারা। GPS ছাড়া নির্ভুল ডেস্টিনেশনে কী করে পৌঁছয়, সেটাই আশ্চর্যের। শীতের মরশুমে গডওয়াল, কটন পিগমি গুস, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, ফেরুজিনাস পোচার্ড, গারগনির দেখা মেলে।
অগভীর জলে লম্বা পায়ের জাকানাদের ব্রোঞ্জ রঙা ডানার ভিতর থেকে ছানা-পোনাদের উঁকি দেওয়া মুখগুলো দেখার তৃপ্তিই আলাদা।
পূর্বস্থলী মানে তো শুধু পাখি নয়, গাছে ঝুলে ঝুলেই গুছিয়ে সংসার করতে দেখা যায় আদুর বাদুর চালতা বাদুর, কলা বাদুরদের। তাদের ছোট ছোট মুখ, একে অপরকে জড়িয়ে রাখা হাত, লম্বা ডানা, সেই দৃশ্যও অনাবিল আনন্দ দেয়।
গাছে ঝোলা আর সন্তান সন্ততি নিয়ে সংসার করায় আর এক প্রজাতির কথা মনে আসে। হ্যঁা, পূর্বস্থলীতে এলে সেই লেঙুর কূলেরও দেখা মিলবে।
মাছ যখন আছে তখন বিড়াল তো আছেই। না শুধুই সাধারণ বিড়াল অর্থাত্্ ফেলিস ডোমেস্টিকাস নয়, ভাম বিড়াল অর্থাত্্ সিবেট ক্যাটও রয়েছে। এরা অবশ্য শুধু মাছ নয়, পাখি, ফল-মূল সবই খায়। মুখ ছোট্ট হলেও বিশাল ফুল ঝাড়ুর মতো লেজটা দেখার মতো। সেই সঙ্গে বাসমতি চালের মতো গায়ের গন্ধ। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও যে গন্ধ বলে দেয়, আশ-পাশেই
ভাম আছে।
আস্তানার অভাবে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া শৃগাল কূলেরও দেখা মিলবে এখানে। পূর্বস্থলীর জলা সংলগ্ন ঝোপ-ঝাড়, সেখানকার ছোট ছোট প্রণী, গ্রামের গবাদি পশু, হাঁস-মুরগীর ভরসায় এখনও সন্ধ্যা হলে এখানে হুক্কাহুয়া রবে গলা সাধে বাংলার শেয়াল দেবতারা।
মন ভোলানো সৌন্দর্য, পুরস্কারের দাবি রাখা পাখির ছবি, খাদ্য-খাদকের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সব কিছুর মাঝেও কোথাও যেন বিপন্নতার চোরা স্রোত বইছে এই গোক্ষুরাকৃতির হ্রদে। যবে থেকে এর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াতের জন্য বাঁধ তৈরি হয়েছে তবে থেকেই এর অগভীর জলে মূল ভাগীরথীর সঙ্গে ঢেউয়ের আদান-প্রদান বন্ধ হয়েছে। ফলে পাড়ের দিকে শ্যাওলা ও পলি জমে কমছে জলভাগ। অন্য দিকে বাড়ছে হ্রদ সংলগ্ন চাষের জমি।
জলচর পাখিদের জন্য বিষয়টা সুখকর না হলেও চাষের জমিতে খাবার হিসাবে পোকা-মাকড়ের জোগান মন্দ না। কিন্তু তাতেও বাদ সেধেছে মানুষ। ফসলের ক্ষতির আশঙ্কায় পাখি ঠেকাতে বেছানো হচ্ছে জাল। সেই জালে জড়িয়ে বহু পাখির মর্মান্তিক মৃতু্য পর্যন্ত হচ্ছে। অন্যদিকে চাষের কাজে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবও পড়ছে পাখিদের শরীরে।
আবার বড় বড় ভেড়ি, যেখান থেকে মাছ মুরালের বড় রুই কাতলার জোগান হত, সেখানেও জালের পাহারা বসেছে। এত কিছুর মধ্যেও পাখিদের কিছুটা হলেও নিরাপদ করেছেন পাখিপ্রেমীরাই। কারণ তাঁরা পাখির ছবি তুলতে আসছেন বলেই এতদিন যে স্থানীয় মানুষেরা পাখি শিকার করতেন এখন তাঁরাই নৌকাচালক বা গাইডের পেশাকে বেছে নিচ্ছেন। পাখিদের গতিবিধি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান এখন পাখি নিধনের বদলে পাখি চেনাতে কাজে লাগছে। আরও বেশি পাখি প্রেমীদের আনাগোনায় যা এই অঞ্চলের অর্থনীতির অন্যতম বুঁনিয়াদ হয়ে উঠতে পারে।
Негізгі бет Purbasthali Bird Sanctuary In Bengali Language | Chupir Char
Пікірлер: 46